করোনার কারণে গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে বিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকলেও বছরের শুরুতে ভর্তি এবং নতুন বই পেতে গুনতে হচ্ছে ৪২ খাতের ফি। এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও তা মানছে না কোনো বিদ্যালয়। ম্যানেজিং কমিটি ও প্রধান শিক্ষকদের স্বেচ্ছাচারিতায় অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন থমকে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত বছরের ১৮ নভেম্বর মাউশি মহাপরিচালক স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিউশন ফি ছাড়া আর কোনো ফি নেওয়া যাবে না। যদি অ্যাসাইনমেন্ট, টিফিন, পুনঃভর্তি, গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানাগার, ম্যাগাজিন ও উন্নয়ন বাবদ কোনো ফি গ্রহণ করা হয়, তা ফেরত দেওয়া অথবা টিউশন ফির সঙ্গে সমন্বয় করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সেখানে আরো উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালের শুরুতে করোনা পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক না হয়, তাহলে টিফিন, পুনঃভর্তি, গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানাগার, ম্যাগাজিন, উন্নয়ন খাতের ফি নেওয়া যাবে না। কিন্তু, বরিশালের স্কুলগুলোতে গত বছরের শুরুতে ভর্তি বাবদ ৩ হাজার টাকা নেওয়া হয়। এর পর আবার সারা বছরের টিউশন ফি আদায় করে। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের খবর দিয়ে এ টাকা আদায় করা হয়। নতুন বছরে ভর্তির জন্য আবার আদায় করা হচ্ছে ৩ হাজার টাকার ফি। ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, নতুন করে ভর্তিতে ৩ হাজার, ২ হাজার ৫৯০ টাকা ব্যতীত কোনো বিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভর্তি নিচ্ছে না। পুনঃভর্তিতে কোনো বিদ্যালয় ১ হাজার ৫০০ টাকা নিলেও অধিকাংশ বিদ্যালয়গুলোতে আদায় করা হচ্ছে ৩ হাজার টাকা।
করোনার দুর্যোগে মধ্য ও নিম্ন-আয়ের মানুষের আয় কমে গেলেও বিদ্যালয়ে সন্তানদের ভর্তি করাতে কোনো ছাড় না পাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ম্যানেজিং কমিটির ধার্য্য বেতন-ভাতা ও উন্নয়ন বাবদ ৪২ খাত দেখিয়ে আদায় করা হচ্ছে টাকা। অথচ করোনার দুর্যোগে অনেক ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীর আয় কমে গেছে কয়েক গুণ। গতকাল শনিবার বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার বেশি শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে দেখা গেছে অভিভাবকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি বিদ্যালয় ছাড়া এর বাইরে বরিশাল মহানগরীতে অর্ধশত বিদ্যালয় রয়েছে। নগরীর হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, জগদ্বীশ স্বারস্বত বালিকা বিদ্যালয়, উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, অক্সফোর্ড মিশন বিদ্যালয়গুলোতে তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার করে শিক্ষার্থী প্রতি বছর ভর্তি হয়ে থাকে। বিদ্যালয় ভেদে প্রতি ছাত্রছাত্রীকে পরবর্তী ক্লাসের ভর্তির জন্য কমপক্ষে আড়াই হাজার টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে ৫ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। টাকা পরিশোধের রসিদসহ বিদ্যালয়ের বই আনতে হবে বলে বিদ্যালয় থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কারণ বকেয়া থাকলে তাকে আর নতুন বই দেওয়া হবে না। এছাড়া নতুন বই নিতে হলে পুরোনো বই বিদ্যালয়ে জমা দিতে হবে।
বরিশাল সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সভাপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর শাহ সাজেদা ইত্তেফাককে জানান, করোনা প্রেক্ষাপটে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে, বিশেষ করে মেয়েরা। কিছু কিছু বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির অনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলে ভর্তিতে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। তিনি এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এ ব্যাপারে জগদ্বীশ স্বারসত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দুই মাসের ছুটিতে থাকলেও টাকা আদায়কারী অফিস সহকারী সন্ধ্যা চক্রবর্তী জানান, প্রধান শিক্ষক যেভাবে নির্দেশনা দেন সেভাবেই তিনি টাকা আদায় করেন। এ বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে ২ হাজার ৫৯০ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে অভিভাবকদের। নগরীর প্রায় ১ হাজার ৮০০ শিক্ষার্থীকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এসএম ফখরুজ্জামান জানান, নতুন বছরের জন্য ৩ হাজার টাকার পরিবর্তে করোনা প্রেক্ষাপটে ১ হাজার ৫০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। তবে অনেকের আবেদনের প্রেক্ষিতে আরো কম কিংবা সম্পূর্ণ ফ্রিও করা হচ্ছে। বিগত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে কেবল সেশন চার্জ নেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) বরিশালের ঊর্ধ্বতনরা একে অপরের সঙ্গে আলাপের পরামর্শ দেন। তবে মাউশি বরিশাল আঞ্চলিক উপপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. আনোয়ার হোসেন জানান, বিদ্যালয়গুলোকে মাউশির বিজ্ঞপ্তি বহির্ভূত কোনো অর্থ আদায় থেকে বিরত থাকার জন্য বলা হয়েছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বীথিকা সরকার জানান, মাউশি থেকে প্রাপ্ত সব রকম বিজ্ঞপ্তি বিদ্যালয়গুলোতে পৌঁছানো হয়। তার পরও তিনি আজ রবিবার বিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে এ-সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখবেন।
ইত্তেফাক